বাক্‌ ১১৪ ।। সম্পাদকীয় ।। অনুপম মুখোপাধ্যায়

চিত্রঋণ : ভোর মুখোপাধ্যায়



।। পাঠকের নাম জানা যাবে না। কোনোদিন হয়ত তার সঙ্গে কথা হবে না। আমরা অনেক সময়ই এমন ব্যক্তিকে নিজেদের পাঠক ভাবি, যে আসলে লেখক, কিন্তু ঠিকঠাক লিখতে শেখেনি, লিখতে পারে না। সে এসেছে আত্মবিশ্বাসের খোঁজে আর আমরা পাচ্ছি আত্মপ্রসাদ। অথবা, লেখার জগতের সহকর্মীদের ভাবছি নিজেদের পাঠক। এটা আরো মারাত্মক। একজন রাঁধুনী তার রান্না আরেক রাঁধুনীর জন্য, একজন ডাক্তার তার দক্ষতা আরেক ডাক্তারের জন্য, একজন মুচি তার হস্তকৌশল আরেক মুচির জন্য রাখে না। কিন্তু একজন কবি আরেকজন কবির প্রশংসা পেলে গলে যায়, নিন্দা পেলে মুষড়ে পড়ে, সে অ-কবিদের পাত্তাই দিতে চায় না। পাঠক কাকে বলে, সে তখন আর ভেবে দ্যাখে না। এটাও ভেবে দ্যাখে না, সহকর্মীর ঈর্ষা থাকতে পারে, অকারণ স্নেহও থাকতে পারে। তার মতামতটা প্রভাবিত হতেই পারে
          ২০১৫-র পরে যাঁরা লিখতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে দু-তিনজন বাদে অবস্থানের স্থিরতা দেখাতে পারছেন না। এঁরা খুব সহজে প্রভাবিত এবং প্ররোচিত হচ্ছেন। যা কিছু মাথার উপর দিয়ে যায়, তাকেই এঁরা পাখি ভাবেন। এর ফলে, এঁরা মেধা এবং চালাকির ফারাক বুঝতে পারেন না। পুরনো মদকে নতুন বোতলে ঢেলে দিলেই চলে, কারণ এঁরা চোলাই কী করে হয়, তার ইতিহাস কী, বোঝেন না। বোঝার সময় খুব বেশি এঁদের হাতে নেই। কিছু লেখার আগেই লেখার জায়গার খোঁজ যে করতে হবে, বাংলা বাজারের এই আইন এঁরা বুঝে নিয়েছেন। সুবিধা অনুসারে যে কোনো লোককে এঁরা ‘দাদা’ বলতে পারেন, পরমহূর্তেই স্বার্থসিদ্ধি না হলে ‘গাধা’ বলতে পারেন। এঁদের সমর্থন আর “ওয়া ওয়া’ কাজে লাগিয়ে শূন্য ও নব্বই দশকীয় কিছু অন্তঃসারশূন্য নাম ফলাও হয়ে উঠছে, অন্তত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। সে এক করুণ দৃশ্য। আবার বলছি, দু-তিনজন ব্যতিক্রম আছেন।
          পুজোসংখ্যা কাকে বলে বলুন তো? যে সংখ্যায় ৩০০ জন কোবি লেখা দিয়েছেন এবং ছাপা হয়েছে। এঁরা সকলেই পত্রিকা কিনবেন। ৩০০ কপি বিক্রি অবধারিত। এমন ওয়েবম্যাগ দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা ইউনিকোডে কম্পোজ করতে পারলে যে কোনো জনের লেখা অবলীলায় ছেপে দিচ্ছেন। কেন বলুন তো? আপনি আপনার ওয়েবম্যাগে ৭৭ জনের লেখা ছাপুন, বাংলায় টাইপ করে পাঠালেই ছেপে দিন। কেন?  কম্পোজ করা একটা লেখা ওয়েবম্যাগে আপলোড করতে তিরিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্ড সময় লাগে। প্রুফ দেখা, পেজ মেক আপ, ট্রেসিং বের করা ইত্যাদির ঝামেলাই নেই। সম্পাদককে ছাপার জন্য একটা লেখা পড়তেই হয় না। ওই ৭৭ জনের মধ্যে ৩৭ জনের লেখা হয়ত একমাত্র লেখক আর তাঁর অঙ্গুলিমেয় বন্ধুবান্ধবই পড়বেন। কিন্তু, এবং এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ 'কিন্তু', তাঁরা সবাই নিজের লেখার লিংক ফেসবুকে শেয়ার করবেন, ফেসবুক জুড়ে ছড়িয়ে যাবে শুধু আপনার পত্রিকার নাম। এগুলো কৌশল। বাঁচার কৌশল নয়। যুদ্ধের স্ট্র্যাটিজি নয়। এগুলো সিঁদকাটা আর পকেটমার আর স্থানীয় নেতাদের স্ট্র্যাটিজি, টিকে থাকার। 
          সবাই যে পত্রিকায় লেখে সেটাকে পত্রিকা বলে না। সেটা ধর্মশালা, বা লঙ্গরখানা। একটা পত্রিকার চরিত্র গড়ে ওঠে তার লেখকসূচি থেকেকিছু লেখক তার লাগে যাঁরা তার কথা ভেবে কাজ করেন। সম্পাদক আর লেখকের বোঝাপড়া এবং চাওয়াপাওয়া থেকে নির্ধারিত হয় পত্রিকার চরিত্র। হ্যাংলা লেখক এবং অবোধ সম্পাদক অজস্র ছড়িয়ে পড়েছেন। কিছু লেখক ভেবেও দেখেন না, কোথায় লিখছেন, সেখানে তাঁর লেখার দরকার আছে কিনা। যে পত্রিকা আপনার লেখা ছাড়া দিব্য চলে যাবে, সেখানে আপনি লিখছেন কেন? কারণ আপনি নিজের নাম প্রতিটি সূচিপত্রে দেখতে চান। ভেবে দেখছেন কি, ওই পত্রিকা কেন আপনার লেখা চাইছে? আপনার লেখার গুণে হয়ত নয়, আপনি বাংলার অপরিহার্য লেখক বলেও নয়, অমন লেখক আজ কেউই নেই। আপনাকে একটা পত্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, যাতে আপনাকে লেখক হিসেবে গড়ে তুলে ও সামনে রেখে তার চলার পথ বিগড়ে যায়, তার আইডেন্টিটি ঘেঁটে যায়। ‘বাক্‌’-এ কিছু শক্তিশালী লেখক আছেন, যাঁরা আন্তর্জালে অন্যত্র লেখেন না। এতে তাঁদের সঙ্গে এই পত্রিকার যে রসায়ণ গড়ে উঠেছে, সেটা অনেকের অস্বস্তির কারণ। সেই কারণের কারণ হল 'বাক্‌'-এর স্বাতন্ত্রের প্রতি তাঁদের অসুবিধার বোধ। যে লেখক নিজেকে শুদ্ধ অবস্থানে দেখতে চান, কিছু পত্রিকার কাজ হয়ে ওঠে তাঁদের সামনে অপ্সরার মতো স্ট্রিপটিজ করা। আমি নিজের অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি, যে পত্রিকা আমাকে অবলম্বন করেছে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা আমাকে ভোলাতে চেয়েছে, কখনও রূপে, কখনও 'ভালোবাসা'-য় ঘিরেছে।
          পরিস্থিতির দিকে তাকালে আশাবাদী হওয়া কঠিন। আজকাল অনেকেই ফেসবুকের স্ট্যাটাস বুঝতে পারেন না, একটু ঘুরিয়ে বললেই বিভ্রান্ত হন, অথচ তাঁরা কবিতার রস নিতে চান। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নামক যে শ্রেণিকে লক্ষ্য করে একদা লেখালেখি হত, আজ সেই শ্রেণি বিলুপ্ত হয়ে আঁতেল নাম ধারণ করেছে। এখন ওই শ্রেণি আর কিছু পড়েন বলে মনে হয় না, শুধু লিখতে চান। পাঠকরা লেখক হয়ে গেছেন পাঠের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে। যে শ্রেণিকে এখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলা হচ্ছে, এঁরা বিবিধ সরকারি সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি এবং চাকরি জোগাড় করেছেন বা করার প্রাণপন চেষ্টায় আছেনএঁদের বাংলা খবরের কাগজ পড়তে মানেবই লাগে, খুব শীঘ্র এঁরা ‘সপ্তপদী’ বা ‘সাত পাকে বাঁধা’ দেখতে বসে বাংলা সাবটাইটেল দাবি করবেন। এবং, এই যে তেতো কথাগুলো বললাম, সেগুলোও এঁরা বুঝবেন না, কাজেই মার্জনা চাওয়ার প্রয়োজনটা বোধ করছি না।
          এখন শুধু এটুকুই চাওয়ার, শরতের অরুণ আলো যেন সব তিক্ততা সব গ্লানি ধুয়ে দেয়। অন্ধকারের অবসান হয় না, কিন্তু তার বুকে ফুটে উঠুক অমৃতময় আলোর রেখাগুলো।।
                                                                                      [অনুপম মুখোপাধ্যায়]